আবহাওয়ার গত কয়েক বছরে যে পরিবর্তন এসেছে তা বেশ অস্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক জনজীবনে বেশ প্রভাব ফেলছে। আর গত কয়েক দিনে সারাদেশে তাপমাত্রার যে বিপর্যয়, তাতে অবস্থা বেশ অসহনীয় ও ভয়ানক পর্যায়ে চলে গেছে। অতিরিক্ত গরমের পিছনে বিশেষ কারণ হচ্ছে, বছরের ঠিক দুই সময় পৃথিবী বিষুব রেখায় সূর্য বরাবর অবস্থান করে। এতে সূর্যরশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পড়ে। ফলে বেশি গরম অনুভূত হয়। এই সময় দিন রাত সমান থাকে।
গরম আবহাওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাদের জন্য-
৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ, ১০ বছরের নিচে শিশু, দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসযন্ত্র বা ডায়াবেটিসের রোগী, যারা সরাসরি সূর্যের নিচে বা গরম এবং কম বাতাসযুক্ত এলাকায় কাজ করেন-এই গরমে সরাসরি সূর্যের নিচে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাপ সংক্রান্ত অসুস্থতা ফুসকুড়ি ঘামের কারণে হয়ে থাকে এবং বিশেষ করে ছোট শিশুদের মাঝে বেশি দেখা যায়। সাধারণত যারা ঘনবসতিপূর্ণ এবং স্যাতস্যাতে এলাকায় বসবাস করেন, গরমে তাদের উচিত ঘরে বাতাস চলালের ব্যবস্থা করা।
শরীরে পানির পরিমাণ অন্যান্য তরল পদার্থ থেকে কমে গেলে ডিহাইড্রেশন হয়। গরমে প্রায় সকলেরই কম বেশি ডিহাইড্রেশন হয়। ডিহাইড্রেশনের ফলে শরীর ভারসম্য বজায় রাখতে পারেনা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে যে কেউ দুর্বল বোধ করেন। তাৎক্ষণিকভাবে চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
শরীর থেকে অধিক পরিমাণে পানির সাথে লবণ বের হয়ে যাওয়ার কারণে হাত ও পায়ের পেশী ক্র্যাম্প করে। হিট ক্র্যাম্প হচ্ছে হিট এক্সশনের প্রথম ধাপ। হিট এক্সশন হচ্ছে অতিরিক্ত গরমে থেকে সৃষ্ট আরেক ধরনের অসুস্থতা। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে হিট এক্সসশনের কারণে অনেক সময় হঠাৎ করে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়।
যখন শরীরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না এবং তাপমাত্রা ৪০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছে যায়, তখন যে কেউ হিট স্ট্রোক করতে পারেন। তাপ সম্পর্কিত এটি সবচেয়ে গুরুতর অসুস্থতা এবং এটি জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলো- ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা এর চেয়ে বেশি জ্বর, চামড়া লাল হয়ে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া । তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ রোগীকে ঠাণ্ডা কোন জায়গায় রেখে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক করতে হবে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে অবশ্যই মিষ্টি বা স্যালাইন দিতে হবে। এতে দ্রুত সুগার লেভেল বেড়ে যাবে।
অতিরিক্ত গরমে করণীয়-
ঘরে যথাসম্ভব ঠাণ্ডা পরিবেশে অবস্থান করুন। অপ্রয়োজনীয় কারণে দিনে, বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা বাইরে বের না হওয়া ভালো। বের হলে অবশ্যই ছাতা সাথে নিবেন। গরমে কালো রঙের ছাতা পরিহার করুন। সারা দিনে প্রচুর পানি পান করুন। বাইরে বের হওয়ার সময় পানি সাথে নিন। দিনে কমপক্ষে ৩লিটার পানি পান করুন। আরামদায়ক পোশাক পরিধান করুন। বাচ্চাদের জন্য সুতির হাল্কা রঙের কাপড় নির্বাচন করুন। খুব গরমে কালো রঙ পরিহার করুন। প্রচুর পরিমাণে মৌসুমী ফল ও ফলের জুস খান। গরমের সময় টক ফল খুবই ভালো। কিন্তু যাদের নিম্ন রক্তচাপ, গরমের সময় তারা অতিরিক্ত টক খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সবুজ সালাদ বা সবজি রাখুন। এতে শরীরে পানি ও খনিজের ঘাটতি হবে না এবং শরীর ঠাণ্ডা থাকবে।
অতিরিক্ত গরমে বর্জনীয়-
অতিরিক্ত গরমে সফট অথবা হার্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। ড্রিঙ্কস শরীরের পানিকে নিরূদিত করে যা শরীরে পানি স্বল্পতা তৈরী করে। এছাড়াও ঘন ঘন পানি পিপাসা পায় এবং গলা শুখিয়ে আসে। তাই গরমে সাময়িক তৃষ্ণা মেটাতে অবশ্যই ড্রিঙ্কস না। গরমের কারণে যেকোনো জায়গা থেকে পানি পানে বিরত থাকুন। দূষিত পানি থেকে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এজন্য পানি পান করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। বাইরে পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মিনারেল ওয়াটার গ্রহণ করুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবারকে না বলুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খারাপ। গরমে তেলে ভাজা বা রিচ ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গরমে এ জাতীয় খাবার যত বেশী খাবেন, তত বেশী গরম লাগবে। সুতরাং এ ধরনের খাবার না খাওয়াই ভালো। স্ট্রিট ফুড বর্জন করুন। স্যালাইন খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। গরমের কারণে ঘরে থাকতে চাইলেও অনেকেই আছেন শারীরিক পরিশ্রম করেন। তাদেরকে কাজের জন্য বাইরে যেতেই হয়। অনেকেই আছেন দিন আনেন দিন খান। সেক্ষেত্রে যেন শরীরে পানি বা লবণের স্বল্পতা না হয় এই জন্য স্যালাইন খেতে পারেন। বাইরে চলাচলের সময় কাছে স্যালাইন রাখতে পারেন। যদি শরীর দুর্বল মনে হয়, সেক্ষেত্রে সাথে সাথে স্যালাইন খেয়ে নিতে পারেন। এতে দুর্বলতা কমবে। প্যাকেটের গায়ে নির্দেশিত পরিমাণ পানির চেয়ে কম পানি দিয়ে স্যালাইন খাবেন না। শুধু স্যালাইন গুড়া খেলে বা কম পানি দিয়ে স্যালাইন খেলে লবণের ঘনত্ব বেড়ে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।
এই গরমে নিজের পাশাপাশি পরিবারের যত্ন নিন। বাইরে চলাফেলার সময় বয়স্ক এবং শিশুদের দিকে খেয়াল রাখুন এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে। কেউ অসুস্থ হলে সচেতনতার সাথে সিদ্ধান্ত নিন। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।